ওরা মানুষ নয়, ওরা শ্রমিক!পুঁজিপতি শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে ডজন ডজন খুন করো,মালিকদের খুশি করতে গ্রেফতার করো যত পারো।যত, বেশি কাজ করানো যাবে, মালিক অর্থাৎ পুঁজিপতি শ্রেণি তত বেশি মুনাফা পাবে।শ্রমিকদের বোবা কান্না দেখার সময় আমাদের নেই। সুন্দর এ পৃথিবীর রূপ-লাবণ্যতায় শ্রমিকদের কৃতিত্ব বেমালুম ভূলে যাও। আক্ষেপ নয়! সভ্যতার কারিগর এ শ্রেণীকে সর্বদাই উপেক্ষা, অবহেলা ও সুবিধাবঞ্চিত না করলে আয়েশে থাকা যাবে না! উদয়াস্ত উষ্ণ ঘামের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ নিয়ে সারাদিন খাটে যে শ্রমিক,সচল রাখে তার মালিকের অর্থযন্ত্রটি, সেই মালিকেরই অবিচারে শ্রমিকদের অচল জীবনটি আরো দুর্বিষহ করতেই হবে।
মৌমাছির মত যারা দীর্ঘ পরিশ্রমের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করে চাকে সঞ্চয় করে, কিন্তু তার ভাগ্যে একফোঁটা মধুও জোটে না!জমিদারী, বাহাদুরী ও ভোগ-বিলাসে মত্ত হওয়ার জন্য শ্রমিকের পেটে যত জোরে লাথি মারতে পারো! বড় বড় জোঁক সেঁজে শ্রমিকের রক্ত যত পারো শোষণ করো!প্রতিবাদ করলে ছাঁটাই করো,শোষণের মাত্রা বাড়াও।ভিক্ষুকের ঝুলিতে কমিশন নাও,রিক্সাশ্রমিকদের জন্য ১০,০০০হাজার টাকার রিক্সা দিয়ে মালিক তুমি বছরে শোষণ করো ৫০,০০০হাজার টাকা।চাঁদাবাজরা ও শ্রমিকদের পিছু ছাড়বে না- সকল শ্রমিকের সামান্য টাকার বকরা বসাও- নইলে ধাক্কা দিয়ে বস্তি বা খুপড়ি ঘর থেকে রাস্তায় লাথি মেরে উল্টে দাও।
শ্রমিকের ঘামে তিলতিল করে গড়ে উঠেছে যে সভ্যতার সুউচ্চ দেয়াল সেই শ্রমিকদের প্রতি আমাদের সামজিক দৃষ্টিভঙ্গিটা ঠিক এমন চিন্তার জগতেই ঘুরপাক খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কেননা এই সমাজ সর্বদাই পুঁজিপতিদের পক্ষেই দাঁড়িয়ে হুঙ্কার দিয়েছে শ্রমিকদের।কথা বলেছো তো শ্রমিকের টুটি চেপে ধরতে প্রস্তুত শতশত নগ্নহাত।একাএকা শ্রমিক আর কতো লড়াই করবে? এমনিতেই বেঁচে থাকবার জীবনযুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করতে করতে সে বড্ড ক্লান্ত।কাগজে কলমে এই দেশে শ্রমিকের পক্ষের আইন, শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ,শ্রমিকের ন্যায্য মজুরী-ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে দিস্তাদিস্তা খাতাভরা থাকলেও বাস্তবে “কাজীর গরু কাগজে আছে গোয়ালে নাই” অবস্থা।
এই সাম্প্রতিক সময়ের কথাই যদি আলোচনা করি তবে আমরা আসলেই কি দেখলাম। সারাবিশ্ব যখন করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত তখন আমাদের দেশের পোশাক শ্রমিক গাদাগাদি পরিবেশে কলের চাকা সচল রেখেছে। আবার ঠিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার যখন সব বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলো তখন কলকারখানা বিশেষত পোশাক শিল্পের মালিক পক্ষ একগুয়েমিতা পরিহার করেননি। বরং নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে হাজার হাজার শ্রমিকদের ট্রাকবোঝাই করে বাড়িতে পাঠিয়েছে,আবার যখন সরকারি প্রণোদনা মনমতো হয়নি তখন বাড়ি থেকে পায়ে হেটে শ্রমিকদের কারখানায় আসতে বাধ্য করেছে।শুধু পোশাক কারখানাতেই নয় দেশের অন্যান্য কলকারখানাতেও এমনই নাটকের অবতারণা যারা করেছিলেন এবং এখনও করে যাচ্ছেন তাদের সবাই পুঁজিপতি। তাদের কাছে শ্রমিকের স্বার্থ নয় বরং কিভাবে পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে ব্যবস্যাটি করা যায় সেটিই চিন্তা করছেন তারা।পুঁজিপতিদের ব্যাংক একাউন্টে শতশত কোটি টাকা মজুদ থাকলেও ভিক্ষুকের স্বভাবটি যে এখনো তাদের মধ্যে থেকে একেবারেই অদৃশ্য হয়নি সেটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যতেই স্পষ্ট হয়েছে।কেননা করোনা মোকাবেলায় সরকারি তহবিলে ১০ হাজার টাকা অনুদান দেয়া শেরপুরের ভিক্ষুক নাজিম উদ্দিনের প্রশংসা করতে গিয়ে তিনি বলেই ফেললেন “আমাদের দেশের অনেকেই আছেন যাদের নাই নাই স্বভাবটা আর যায়না, তাদের ভিক্ষুক নাজিম উদ্দিনের থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত”। শ্রমিকের ঘামের টাকায় সরকারি প্রণোদনা প্যাকেজ পাওয়া এসব পুঁজিপতিদের আচরণে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও বোধকরি কিছুটা বিরক্ত।
এটাতো গেলো শ্রমিকের বাড়িতে ফেরত আর কর্মস্থলে নেয়ার গল্প।এখন যদি বলি সরকার যেসব শর্তে তাদের কারখানার চাকা ঘুরাতে অনুমতি দিয়েছে তারা কি সেগুলো মানছেন? মোটে ও মানছেন না।এখনো কারখানাগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোন বালাই নেই। অথচ সুস্থ কর্মপরিবেশে কাজ করা শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার।শ্রমিক অসুস্থ থাকলে উৎপাদনে দারুণভাবে ব্যাঘাত ঘটে।বাড়ি থেকে ফেরত শ্রমিকরা তাদের ভাড়াকৃত মেস বা বাসায় ঢুকতে পারছেননা। অনেক কারখানা লে-অফ নামক বিচিত্র নাটকের অবতারণা করেছে। নারায়নগঞ্জে প্রতিনিয়তই শ্রমিকরা তাদের বেতন ভাতার দাবিতে বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে। অপরদিকে প্রায় মাসাধিক সময় দেশের গণপরিবহন বন্ধ থাকায় এর সাথে জড়িত কয়েকলক্ষ শ্রমিকের ঘরে দূর্ভিক্ষের হাহাকার বাতাস ভারী করছে প্রতিনিয়ত।
রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে শ্রমিক কল্যাণের নামে এতোদিন যে চাঁদা তোলা হলো, সেই অর্থ আসলেই শ্রমিকের কোন কল্যাণে কাজ করেছে সেটা আমার মতোএই দেশের ১৬ কোটি মানুষের বোধে আসছেনা।শ্রমিক সংগঠনগুলোও এখন প্রায়নিশ্চুপ। তারাও বোধকরি সরকার ঘোষিত পুঁজিপতিদের বিশেষ প্যাকেজে প্যাকেজিত হয়ে বসে আছেন।কেননা শ্রমিক সংগঠনগুলোও এখন বড়বড় পুঁজিপতিদের দখলে।সরকারি প্যাকেজ দেয়া এবং কড়ায় গণ্ডায় সেটা বুঝিয়ে নেয়া সবটাতেইতো তাদেরই হাত! শ্রমিক কল্যাণে দাবি আদায়ের সময় কোথায় তাদের? অবশ্য এ বিষয়ে শুধু তাদেরএককভাবে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বরং সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টিতে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহনে ব্যর্থ হয়েছে বরাবরই।সবজায়গাতেই আজ পুঁজিপতিদের রামরাজত্ব। এমনইএকপরিস্থিতিতে দেশে পালিত হবে মহান মে দিবস। শ্রমিকের আত্মমর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করার ও ন্যায্য দাবি আদায়ের এক ঐতিহাসিক দিন। ১৮৮৬ সালের এ দিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমের মর্যাদা, শ্রমের মূল্য এবং দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে শ্রমিকেরা যে আত্মাহুতি দিয়েছেন তাদের আত্মত্যাগের প্রতি একাত্মতা, শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে বিশ্বব্যাপী এ দিবসটি পালিত হয়।কিন্তু এবছর বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারিতে কার্যত স্থবির বিশ্বের আনাচে কানাচে। হয়তো দিবসটি উপলক্ষে শ্রমিকের দাবিদাওয়া সম্বলিত লিফলেট,প্লাকার্ড হাতে মিছিল হবেনা,কিন্তু আগের মতোই শ্রমিকের হাতে সচল থাকবে অর্থযন্ত্রের চাকা।
শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদা, ন্যায়সংগত অধিকার ও কল্যাণের সাথে মহান মে দিবসের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শোষণ, বঞ্চনা, লাঞ্ছনা থেকে মুক্তির দীপ্ত শপথে বিশ্বব্যাপী শ্রমিকরা স্বপ্ন বুনতে শুরু করে দিনটি উপলক্ষে। দেশের বিশাল শ্রমজীবী মানুষের যথাযোগ্য মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিতকরণ, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, শিশুশ্রম নিরসন, ন্যায্য মজুরি নির্ধারণ, শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্কের মধ্য দিয়ে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা এবং দ্রারিদ্র্যমুক্ত উন্নত, সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়ার শপথ হোক এবারের মে দিবসের অঙ্গীকার।
মে দিবস পালন তখনই সার্থক হবে, যখন শ্রমজীবী মানুষ ন্যায্য মজুরি ও নিরাপদ কর্মস্থলের নিশ্চয়তা পাবেন। মহান মে দিবসে আমাদের প্রত্যাশা, বাংলাদেশে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা হবে। মহান মে দিবসে সব শ্রমজীবী মানুষের প্রতি রইল আমাদের অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশে শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক। তাদের সবার জীবন আরো সুন্দর ও আনন্দময় হোক।
এম এম মেহেরুল
লেখক ও সাবেক চেয়ারম্যান,আলোর প্রদীপ
ই-মেইলঃ allorprodip2008@gmail.com