আমাদের দেশের দালানগুলো প্রতিনিয়তই উঁচু থেকে আরো উঁচু হচ্ছে। হুরহুর করে বাড়ছে সভ্যতা।তরতর করে উপরে উঠার সিঁড়িটা না খুজলেই নয় আজকালকার মানুষদের।সভ্যতার দালানকোঠা বাড়ছে,উঁচু হচ্ছে বটে কিন্তু মানুষগুলো সভ্য জগত থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে আদিম অসভ্যতায়।যে আদিম অসভ্যতায় নারী ছিলো শুধুই পুরুষের যৌন দাসী আর সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র।পুরুষ যে যেমন করে ইচ্ছে ব্যাবহার করেছে একজন নারীর শরীরকে,খামছে খুবলে খুবলে চেটেপুটে উপভোগ করেছে তার প্রত্যেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ।একবিংশ এই শতাব্দীতে এসেও পুরুষ তথা আমাদের গঠিত এই সভ্যতা নারীদের সেই উপভোগের বস্তু হিসেবে ভাবনার জায়গা থেকে বেরিয়ে আনতে পারেনি আজও।বরং প্রতিনিয়তই আরো আষ্টে পৃষ্টে যতোটা পারা যায় খুবলে খাওয়া যায় সেই ব্যাবস্থাই যেন পাকাপোক্ত করছে।যার উদাহরণ হতে পারে প্রতিদিনকার সংবাদের চিত্র।একেকটা লোমহর্ষক ঘটনা আমাদের এই উঁচু উঁচু সভ্যতার দালানগুলোকে সজোরে আঘাত করে ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছে।আজ থেকে গত শতাব্দিতেও নারীদের প্রতি আমাদের সমাজের নির্যাতনের মাত্রা ছিলো বটে কিন্তু সেটা বিকৃত যৌনতার পর্যায়ে নয়।কিন্তু আজকাল নিজ ঘরে স্বদর্পে বৌ পেটানোর ঘটনা নেই, কিন্তু বাড়ির বাইরে মানে বাড়ি থেকে বেরুলেই কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর কি নারীর কর্মক্ষেত্র! সবর্ত্রই নারীদের খুবলে খাওয়ার জন্য হায়েনার নখগুলো চকচক করছে।অনেকেই নারীর এই নির্যাতনকে ধর্মীয় দিক থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন।নারীর চলন বলন নিয়েও প্রশ্ন তোলেন হাজারটা। কিন্তু সমাজের বাস্তব চিত্র ভিন্ন কথা বলে ,ধর্মীয় ধোয়া তোলা মানুষগুলোর চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে পর্দার আড়ালেও হাজার হাজার নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।সৌদি নামক ধর্মীয় অনুভূতির দেশেও নারী নির্যতনের অসভ্যতার ইতিহাস কারোই অজানা থাকবার কথা নয়।কেননা ইতিমধ্যেই এই দেশ থেকে যে নারীরা গিয়েছিলো জীবিকার তাগিদে তাদের সাথেও চরম অসভ্যতা করা হয়েছে।যার ফলশ্রুতিতে কয়েক হাজার নারীকে গর্ভবতী হয়ে দেশে ফেরত আসতে হয়েছে আর বাংলাদেশ সরকারকেও নিতে হয়েছে কঠোর অবস্থান।কুমিল্লার তনু থেকে সোনাগাজির নুসরাত এরা সবাই ধর্মীয় রীতিনীতি মেনেই হিজাব পড়তো,পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে রাখতো যেন অন্যর কুদৃষ্টি না পড়ে। কিন্তু না কুদৃষ্টি সেই ধর্মীয় আভ্রুকেও ভেদ করে ঠিকই পৌছিয়েছিলো তাদের গোপনাঙ্গ পর্যন্ত। কদিন আগেই ফতুল্লার মাহমুদপুর এলাকার বাইতুল হুদা ক্যাডেট মাদ্রাসায়একজন মাদ্রাসা অধ্যক্ষ ১২ জন শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের দায়ে গ্রেফতার হয়েছেন।শুধু যে মাদ্রাসাগুলোতেই এমন ঘটছে তা কিন্তু নয়।নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে শিক্ষককর্তৃক ২০ জনেরও বেশি ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনারগ্রেফতার হয়েছেন একজন শিক্ষক।এমনকি সহকর্মীর নিকট নির্যাতনের শিকার কয়েকশ নারী মুখ খুলছেন ধীরে ধীরে। সভ্য সমাজ হিসেবে দাবি করা সমাজের এই যে অসভ্যতার চিত্রটি দিনদিন ভেসে উঠছে তাতে কি আমাদের আধুনিক সমাজ সভ্যতার দেয়ালকে ভেঙ্গে চুরমার করছে না?
নারীর প্রতি এই সহিংসতা বা নির্যাতন কোনো বয়সের মাত্রা দেখে ঘটছে না। এর শিকার হচ্ছে শিশু থেকে বৃদ্ধা সবাই। একের পর এক ধর্ষণ নির্যাতনের ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করে চলেছি। এখানে আমরা কেবলই দর্শকের ভূমিকায় আছি। খুব বেশি হলে রাস্তায় নেমে ব্যানার হাতে দুই চারটা প্রতিবাদ হচ্ছে, মিছিল হচ্ছে, পত্রিকায় লেখা হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ আমাদের দেশে চলমান বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি আর নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হওয়া। যতোদিন একজন নারীকে ঠিক মায়ের,বোনের আসনে বসাতে না পারবো ঠিক ততোদিন পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান নেই।কদিন আগেই এক বয়স্ক মুরুব্বির কথার প্রবল প্রতিবাদ করতে বাধ্য হয়েছিলাম ঠিক এই কারনে। তিনি নারীদের শয়তানের জাল বলে আখ্যায়িত করলেন এক মুহুর্তেই।অথচ তিনি নিজে যার গর্ভে জন্মেছেন সেও একজন নারী,তিনি যার সাথে ঘরসংসার করছেন তিনিও একজন নারী,আবার তার ঘরে আদরের সন্তানটিও একজন নারী কিন্তু তার দৃষ্টিভঙ্গিটি সম্পূর্ণ আলাদা। এই যে দৃষ্টিভঙ্গির ধরণ এই ধরণের কারনেই নারীর প্রতি সহিংসতা কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না।আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা ঠিক এমন; নারীর হৃদয় কোমল না হলে সে আবার নারী নাকি? নারীরা কখনো কঠোর হতে পারে না। নারীর বিশ্রামের অধিকার নেই, কাজ না করে ইচ্ছা পূরণের অধিকার নেই। নারীর কোনো নিজস্ব ঘর থাকতে নেই। নারীর কোনো নিজস্ব মত থাকতে নেই, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ততটুকুই পাবে যতটুকু তার পরিবার তাকে অনুমোদন দেবে।
প্রায় অবাধ ধর্ষণ চলছে আজ পৃথিবী জুড়ে। ধর্ষণ আজ দেখা দিয়েছে মারাত্মক মড়করূপে।আমেরিকার মতো শিল্পোন্নত সমাজে যেমন চলছে ধর্ষণ, তেমনি চলছে বাংলাদেশের মতো অনুন্নত সমাজে। অবস্থাদৃষ্টেমনে হচ্ছে পৌরাণিক দেবতারা আর ঋষিরা দলবেধে জন্মলাভ করেছে বাংলাদেশে। সচেতনতার অভাব ও সমাজের লোকলজ্জার ভয়ে ধর্ষণের সব সংবাদ অবশ্য জানা যায় না।সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে ধর্ষিতারাই তা চেপে রাখে; কিন্তু যতটুকু প্রকাশ পায় তাতেই শিউরে উঠতে হয়। বাংলাদেশে ধর্ষণ সবচেয়ে বিকশিত সামাজিক কর্মকান্ডের একটি, পৃথিবীতে যার কোনো তুলনা মেলে না। বাংলাদেশে যেমন এককভাবে ধর্ষণ করা হয়, তেমনি দলবেধে ধর্ষণ করার ঘটনা নেহাতই কম নয়। আর এখন নতুন করে যুক্ত হয়েছে ধর্ষণের পর ঠান্ডা মাথায় খুন করা। এখানে পিতা ধর্ষণ করে কন্যাকে (কয়েক বছর আগে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরে এক পিতা ধর্ষণ করে তার তিন কন্যাকে), জামাতা ধর্ষণ করে শাশুড়ীকে, সহপাঠি ধর্ষণ করে সহপাঠিনীকে, আমলা ধর্ষণ করে কার্যালয়ের মেথরানিকে, গৃহশিক্ষক ধর্ষণ করে ছাত্রীকে, ইমাম ধর্ষণ করে আমপারা পড়তে আসা কিশোরীকে, দুলাভাই ধর্ষণ করে শ্যালিকাকে, শ্বশুড় ধর্ষণ করে পুত্রবধুকে, দেবর ধর্ষণ করে ভাবীকে। দেশ জুড়ে চলছে অসংখ্য অসম্পর্কিত ধর্ষণের মহৎউৎসব।
সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি দেখলে মনে হবে ধর্ষিত হওয়া যেনো নারীরই অপরাধ – কেন সে দু-পা চেপে সব কিছু বন্ধ করে রাখেনি? ধর্ষণের বিচার ধর্ষিতার জন্যে চরম বিভীষিকার ব্যাপার। নিউজিল্যান্ডে ধর্ষণ সম্পর্কে গবেষকেরা জানিয়েছেন ধর্ষিতরা বিচারের পীড়নকে খারাপ মনে করে ধর্ষণের থেকেওযা অনেকটা ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার সমতুল্য। ধর্ষিত নারী বিচার চাইতে গেলে ধর্ষিত হয় কমপক্ষে তিনবার- দুবার রূপকার্থে।
আমাদের দেশে যখন নারীরা বেশি বেশি করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে তখন সমাজের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতার পরিবেশ তৈরির প্রচেষ্টা চালাচ্ছে একধরণের অপশক্তি।আর সেই অপশক্তির প্রাধান্য পাবার মূল কারণ হচ্ছে এখনো আমাদের সমাজ নারীদের বহির্মুখী হিসেবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয়নি। এই যে প্রতিদিনের সহিংসতার চিত্র এটা কী নতুন? না হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে? না, নতুন নয় কিছুই। নারীর প্রতি সহিংসতা,যৌন নির্যাতন সবই ছিল কিন্তু আগে নারীরা মুখ খুলতো না বলে অনেক ঘটনা চাপা পড়ে যেতো। এখানে অবশ্য মিডিয়া জগতের একটা বিশাল ভূমিকা রয়েছে। প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা এখন অনেক বেশি আধুনিক। মগজে মননে আধুনিক না হলেও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে এগিয়েছি অনেক। এই প্রযুক্তি কল্যাণে এখন গ্রাম থেকে শহর সব জায়গাতেই মুহূর্তের মধ্যেই যে কোনো ঘটনা ছড়িয়ে পড়ছে। নির্যাতিত নারীরাও এগিয়ে আসছে নিজেদের কথা বলতে, প্রতিবাদ করতে।
আমাদের দেশে আমরা গর্ব করে বলি নারীরা এখন অনেক ক্ষমতাশালী। প্রশাসন থেকে শুরু করে দেশ পরিচালনায় আছে নারীদের অংশগ্রহণ। ভালো কথা। আনন্দিত হই আমরা। কিন্তু এর সবই তুচ্ছ হয়ে যায় যখন দেখি সাত বছরের শিশু সামিয়া আফরিন সায়মার যোনি কেটে ধর্ষণ করা হচ্ছেআমরা লজ্জিত হই এসব দেখে। একের পর এক ঘটনা ঘটে চলেছে কিন্তু একটারও কোনো বিচার হয় না।
সরকারের লক্ষ্য অর্জিত হয় কিন্তু সমাজ থেকে নারীর প্রতি কুরুচিপূর্ণ দৃষ্টির পরিবর্তন হয় না বরং দিনে দিনে আরো মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। বিচারহীনতার এই অবস্থাই আজকে নারীর প্রতি সহিংসতাকে উসকে দিচ্ছে। নারী হলেই পুরুষরা ধরে নেয় তাকে নিয়ে যা ইচ্ছা তা করা যায়। ঘরে ঘরে নারী নির্যাতন চলে শহর থেকে গ্রামে সব জায়গায়। কী শিক্ষিত কী অশিক্ষিত কেউই এখানে আলাদা নয়। শিক্ষিত সমাজে নারী নির্যাতন চলে ঘরের কোনে। নারীর কান্না সেখানে চার দেয়ালে চাপা পড়ে । পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার কাছে ক্ষমতাহীন নারী বড় অসহায় হয়ে যায়। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হলে একদিকে দরকার কঠোর আইনের শাসন নিশ্চিত করা আরেকদিকে দরকার সমাজে নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার মতো ব্যাপক সচেতনতামূলক কার্যক্রম। সেই কাজ কেবল সরকার নয়, ব্যক্তি থেকে শুরু করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে নারীরাও এই সমাজের অংশীদার। সমাজ গঠনে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অবদানকে তুলে ধরতে হবে নানাভাবে।তবেই কেবল পরিবর্তন হবে আমাদের সমাজ,এই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি।
এম এম মেহেরুল
লেখক ও চেয়ারম্যান,আলোর প্রদীপ
ই-মেইলঃ- meharul.islam.1991@gmail.com