ইকবাল কবির লেমনঃ ভালবাসা শব্দটিই একটি পরম অভিব্যক্তি। কেউ ভালবাসে মানুষকে । আবার কেউ ভালবাসে পাখি, প্রাণি, গাছপালা বা অন্য কিছুকে। এমন ভালবাসার মানুষের সংখ্যা আমাদের সমাজে খুবই কম। সেই কমসংখ্যক মানুষদের একজন পাখি ও প্রকৃতিপ্রাণ ইমরান এইচ মণ্ডল।
খুব সহজে বদলে দেওয়া একজন মানুষ ইমরান এইচ মণ্ডল। বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে পড়াশুনা শেষ করে সোনাতলা উপজেলা ও পার্শ্ববর্তি এলাকায় প্রাণপ্রকৃতি নিয়ে কাজ শুরু করে ইমরান। ছাত্রজীবন থেকেই ইমরানকে পাখি, বন্যপ্রাণী এগুলো খুব টানতো। সেই সুবাদে সে বন্যপ্রাণী রক্ষার্থে ‘পরিবেশ উন্নয়ন পরিবার’ নামে একটি সংগঠন তৈরী করে। পড়ার পাশাপাশি কিংবা ছুটির সময় সে পাখি ও জীববৈচিত্র নিয়ে কাজ করতে উৎসুক ছিল। এলাকায় সে পাখির বাসস্থান হিসেবে প্রায় দুই হাজার কলস স্থাপন করে ও যারা ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করতো,তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় থানায় অভিযোগ করে, কিংবা সচেতনতা বৃদ্ধি করে পাখি শিকারীদের সরিয়ে আনতো। এই দিয়েই যাত্রা শুরু তার। এরপর সে বিভিন্ন এলাকায় পাখি ও বন্যপ্রাণী নিধনকারীদের মধ্যে সচেতনতা সভা ও সেমিনার করেন। শপথ নেওয়ান যারা পাখি শিকার করেন তাদের। এলাকার জনগনকে আগ্রহী করে তোলে পাখি শিকারীদের বাধা প্রদানের জন্য। বন্যপ্রাণী ও পাখির প্রতি ভালবাসার কাজকে আরও গতিশীল করতে তিনি বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট এর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
প্রকৃতি ও পাখিকে তো ভালোবাসে সবাই। কিন্তু পাখির প্রতি ভালোবাসার প্রকাশের ধরণটা এক এক জনের ক্ষেত্রে এক এক রকম। কেউ হয়তো বাসার খাঁচায় পাখি পুষতে ভালোবাসেন, আবার কেউ খাঁচার পাখিকে মুক্ত করে দিয়ে আনন্দ পান। অনেকে আবার ভালোবাসার মানুষটিকে আদর করে পাখি সম্বোধন করে। এমনও কিছু মানুষ আছে যারা নির্বিচারে পাখি মেরে ফেলে বা পাখির ছানা ধরে নিয়ে গিয়ে নষ্ট করে ফেলেন। আর সেক্ষেত্রে সচেতনতার হাত নিয়ে সেখানে হাজির হন পাখিপ্রাণ ইমরান ও তার বাহিনী। বন্যপ্রাণী রক্ষায় মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায় ইমরান ,অবিবেচক মানুষদের সচেতনতা বৃদ্ধি করেন। পাখি শিকারীদের প্রতিরোধ করার জন্য বিভিন্ন মানুষের সাহায্য প্রার্থনা করে ইমরান। এজন্য অনেকের রোষানলেও পড়তে হয় তাকে। এলাকার লোকজন ইমরানদের এ কাজকে প্রথমে এ হেয়ালি মনে করলেও পরে অনেকেই তার পাশে এসে পাখি ও প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলনে শামিল হয়েছেন।
তার পাখি ও প্রকৃতি সংরক্ষণ সচেতনতা ধীরে ধীরে বিস্তৃতি লাভ করেছে বগুড়ার সোনাতলা উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তি এলাকাগুলোতে। কখনো বা নিজ এলাকায় আবার কখনো ভিন্ন জেলায় নিজের অর্থ খরচ করে যারা পাখি শিকার করে তাদেরকে সচেতন করে বেড়ান তিনি। আবার কখনো বিভিন্ন স্কুল কলেজে শিক্ষার্থীদের নিয়ে সচেতনতামুলক অনুষ্ঠান করেন। পাখি শিকারীদের সামনে পেলে যেন তারা বাধা দেয় সে এই শপথ করান, পাখি শিকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস যোগান। নিভৃতে প্রকৃতির সেবায় নিয়োজিত আছেন ইমরানের মত মানুষেরা।
ইমরান ও তার সংগঠনের কাজ বিষয়ে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট এর পরিচালক জহির উদ্দিন আকন বলেন, ইমরান ও তার সংগঠনটির কাজের মাধ্যমে মানুষ পাখি ও বন্যপ্রাণীর প্রতি সচেতন হবে।’
এমন ব্যাতিক্রমী কাজে কেন উদ্বুদ্ধ হলেন এমন প্রশ্নের উত্তরে ইমরান জানান, ‘আমি পাখি-প্রকৃতি, বন্যপ্রাণী, এমনকি সাপকেও ভালবাসি। কারণ, সব সাপই বিষাক্ত না। মানুষের মত সব প্রাণীর বাঁচার অধিকার আছে। তাই তাদের নিয়ে কাজ করি। আরও বলেন, ‘সবার কাছে আমার অনুরোধ,পাখি ও বন্যপ্রাণীর প্রতি সবাই সদায় হোন। বন্যপ্রাণী ও পাখি নিধনকারীদের প্রতিরোধ করুন। প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ বাঁচান, নিজে বাঁচুন। প্রকৃতির সন্তানদের বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করুন। আমাদের দেশ থেকে অনেক জাতের পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতি-পরিবেশ, জলবায়ুর ভারসাম্য ঠিক রাখতে হলে আমাদেরকে প্রকৃতির প্রাণ পাখি, বন্যপ্রাণী ও বৃক্ষরাজি টিকিয়ে রাখতে হবে।’
পাখি ও প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলনে অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ ইতোমধ্যেই প্রয়াস সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন ইমরান। প্রতিদিন বগুড়ার সোনাতলায় ইমরানের ব্যতিক্রমী কার্যক্রম দেখতে ভীড় করছেন প্রকৃতিপ্রেমীরা।
প্রকৃতি ভাবনায় ভাবিত সজ্জন ব্যক্তিরা মনে করেন, ইমরানের মতো এভাবে প্রকৃতি ও পাখিদের সেবার বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা সবাই যদি এগিয়ে আসি তবেই প্রকৃতির সন্তানরা বাধা-বিপত্তিহীনভাবে স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকতে পারবে, রক্ষা হবে প্রকৃতির ভারসাম্য ।’