ফাজল, এ ফাইজল, ফাইজলে..? মুখে এখন ফজলের নামটাও পূর্বের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে উঠে না। মানুষের বয়স হলে যা হয়। জীবন কখনো থেমে থাকে না। সুখ দুঃখ কষ্ট আরাম-আয়েশকে উপভোগ করে জীবন এসে ধরা দেয় বয়সের কাছে। শরীর বুড়িয়ে আসে। দেহের চামড়া হাজারো ভাঁজে পরিণত হয়। বাবার দেওয়া খরচের লিস্ট দেখে যে কপাল কুঁজকে উঠতো; সে কপাল
এখন চিরস্থায়ীভাবে বয়সের ভাঁজে কুঁজকে পড়ে গেছে। খেলাধুলা থেকে ধরে এনে হাতে বই দেওয়ার পর মুখের দাঁত গুলো যে কতই কিটিরমিটির করতো। এখন দাঁতশূণ্য মাড়িতে নবাগত শিশুর মতো অনুভব হয়। আচার আচরণেরও অনেক বড় এক
পরিবর্তন এসময় দেখা দেয়। বাড়ির এই চাচা মিয়াও অবুঝদের মতো আচারণ করা শুরু করছে আজকাল । আজ প্রায় বছর দু’য়েক হয়ে এলো বিছানায় শুয়ে থাকে শুধু। কোমড় ভেঙে গেছে। বৃষ্টির দিনে কেউ বাহিরে যায়? তাও আবার অসুস্থ এক বয়স্ক
মানুষ? উনি যাবে। কারও কথার কোনো মূল্য নেই এই মানুষটার কাছে। চাচি এত করে না করলো ‘বাহিরে যাওনের দরকারডা কী?’ কিন্তু সে যাবেই। সবাইকে অমান্য করে সে চলে গেলো। আর যখন ফিরে এলো তখন প্রায় চারিদিকে সন্ধ্যা নেমে
এসেছে। নেমে এসেছে এক নির্জন পরিবেশ। বাহিরে কেউ নেই। সবাই হয়তো নতুন চালের খিচুড়ি রান্নায় বউকে সাহয্য করছে। চাচা মিয়া বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই মূল ফটকের সামনেই পা পিছলে পরে গেলো। সারা দিনের বৃষ্টিতে ভেজা আঙ্গিনায়
কাদা জমে ধান রোপণের মাঠে পরিণত হয়ে আছে। চাচার শরীরে কাদার প্রলেপ পড়ে গেলো। চিৎকার চেঁচামেচি করতেই সবাই ঘরের বাহির হলো। মেয়ে এবং স্ত্রী যখন বারান্দা থেকেই চেঁচামেচি করছে তখন ফজল দৌড়ে গিয়ে চাচা মিয়াকে পাঁজকোলা করে নিয়ে বারান্দায় এলো। সেখানেই উনার কোমড় ভেঙে যায়। তারপর থেকে একটি করে দিন যায় একটু করে অসুস্থতা বেড়েই যায়।
এখন সারাদিন ঘরে শুয়ে থাকে আর নানান কথা বলে যায় একা একাই। জীবন এক অদ্ভুত উপদান। কখন কোন দিকে মোড় নেয় বলা মুশকিল। নদীর মতোই একটি জীবনের হাজারো বাঁক থেকে যায়। এক সময় এ বাড়িতে ঊনার কথা শোনার জন্য সবাই হা করে অপেক্ষা করতো। এখন কেউ নেই। যার হুকুম ছাড়া এ বাড়ির বাহিরে যাওয়া নিষেধ ছিল; আজ তাকে কেউ তোয়াক্কা করে না। বাড়ির বাহিরে যাওয়ার অনুমতি তো দূরেই থাক তাকে একবার বলাও প্রয়োজন মনে করে তার জন্মদাতা মেয়ে, তার বিবাহিত স্ত্রী। এখন সে অবুঝ। অনেক কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। ফজলকে ডাকতে ধরলে অনারগোল বিরতিহীন ভাবে ডেকেই যাবে। আর যেদিন বাড়িতে কেউ থাকবে না সেদিনতো সারাদিনই খালি ফজল আর ফজল। ডাকুক, আরও ডাকুক তাতেও কোনো দুঃখ নেই ফজলের। দুঃখ শুধু একটাই এত তড়িঘড়ি ডাকের কোনো কারণ নেই। নেই কোনো
প্রয়োজন। ‘সমস্যা কী? ডাকেন কিল্লাই?’ ‘আমার পাইশে এট্টুনা বইস। ডর হরে।
‘ ‘আহাহা হের পাশে হারাদিন বইয়া থাকি। হের নাকি ডর করে। শালারপুতে থাত্তি মেরে ফেলে দিব এক্কিরে। আমার কাম করব কিডা তোর বাপ?’ ‘
তুই আমার থাথে খারাপ ব্যবার করিস। তোর চাইচি আসলে বলি দিবাই।
‘ ‘যা যা বল, এখনি বল। যদি চাচিকে বলিস শালারপুতে তোরে আর বিড়ির আগুন দিব না। ‘বাবা বলবো না। একতা বিড়ি ধরাইয়ে দে।’
চাচি বাড়িতে নেই। মেয়েকে নিয়ে বন্দরে গেছে। ফজল সারাদিন বকাবকি করলেও সে কারো কাছে নালিশ করবে না। কারণ সে ভালো করেই জানে তার একমাত্র কাছের মানুষ এখন এই ফজলই। কারণ বাড়ির কেউ তাকে এখন আর বিড়ি খেতে দেয় না।
একমাত্র জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফজল লুকিয়ে লুকিয়ে বিড়ি ধরিয়ে দেয়। তাছাড়া তার কথা এখন অনেকেই বুঝতেও পারে না। নালিশ করেই বা কি লাভ হবে? ঘটির মধ্যে লুকিয়ে রাখা বিড়ির প্যাকেট হতে একটা বিড়ি বের করে এনে আগুন
ধরালো ফজল। কাউকে পরোয়া না করে নিজে আগে দু’টো সুখটান দিয়ে নিলো। শুয়ে থেকে চাচা মিয়া টান টান করে চেয়ে থাকলো শুধু ওর ফুঁকে দেওয়া ধুয়ার দিকে। আর নিজেকে অনেক অসহায় মনে হতে লাগলো। জীবনের বয়স হয়ে এলে কত কিছুই না মেনে নিতে হয়। এই ফজল তার সামনে বিড়ি ফুঁকছে। সে কিছুই বলতে পারছে না। বললে যদি তাকে আর না দেয়! সেই ভয়ে। অথচ একদিন এই বিড়ি খাওয়ার জন্য বাড়ির পিছনের আম গাছের সাথে প্রায় ঘন্টা দেড়েক বেঁধে রেখেছিল ফজলকে এই চাচা মিয়া।
জীবন বেলা গড়িয়ে যায় তেড়ে উঠা সূর্যটার মতোই। তা যেন আজ চোখের সামনেই দেখছে সে।